শনিবারের বিকেল, শহর থেকে ফেরার পথে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে তারিক আনাম খান আর অর্চিতা স্পর্শিয়ার উছলে পড়া হাসিমুখ দেখে মনেমনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম—'আবার বসন্ত' সিনেমাটা দেখা যেতে পারে, কত দিন কত দিন আমি সিনেমা দেখি না!

একসময় সিনেমা হল-ই ছিল আমার ঘরবাড়ি। স্কুল পালিয়ে কত্ত সিনেমা দেখেছি এই আমি। সুমনা জানো, মেট্রিক পরীক্ষা শুরুর তিনদিন আগে ঢাকার সনি হলে আমি ইলিয়াস কাঞ্চনের সিনেমা দেখেছি, শাস্তিস্বরূপ পিতাজির অমৃত বচনও হজম করতে হয়েছিল!
শুধু কী তাই, সে সপ্তাহে নৈর্ব্যক্তিক গাইডের ভেতর লুকিয়ে শরৎ বাবুর 'দেবদাস' পড়েছি আর হু হু করা মন নিয়ে দক্ষিনের জানালা দিয়ে অপলক তাকিয়ে থেকেছি... তখন পার্বতীর মুখ ছাপিয়ে আমার চোখে সুমনার মুখটা ভেসে উঠত; আমার কেবল মনে হতো—আমারও কী দেবদাসের মতো দশা হবে!?
ভাগ্যিস তা হয়নি, পরীর মতো একটা মেয়ের বর হতে পেরেছি!
শহর থেকে বাসায় ফিরে পরীটাকে বললাম, আজ তোমার মেয়েকে নিয়ে কোচিং-ফোচিং যেতে পারবো না—আজ আমি সিনেমা দেখতে যাবো।
পরী আমার আকাশ থেকে নেমে এল যেন, তারপর ওর মায়াভরা চোখ দুটো মেলে বলল, নেট থেকে নামিয়ে দেখলেই ত হয়, সঙ্গে আমরা সবাই দেখলাম।
আমি পরীর থুতনি ছুঁয়ে বলি, উহু না, হয় না, সিনেমা হলে সিনেমা দেখার স্বাদ বাসায় পাবো না... চলো তুমিও, দুজনে সেই কবে বলাকায় 'চোরাবালি' দেখেছিলাম, এরপর ত আর যাওয়া হয়নি...
পরী সাফ বলে দিল, আমার কাছে কোনো টাকা নেই।
আমি বেশ আস্থার সঙ্গে বললাম, আমার কাছে আছে...
ও তখন খুশির ভাব নিয়ে বলে, তাহলে ত এই সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না, ফ্রি ফ্রি সিনেমা দেখা...
সত্যি সত্যি দুজনে চটজলদি বাইরে পা রাখলাম, তখন বাতাসে রোদের ঘ্রাণ...হু কেয়ারস!
তিনচাকার ভ্যানে বসে চেপে বসি...
একটু পর নিচুস্বরে পরীকে বললাম, তোমার কাছে কত আছে?
—কিছু নেই।
—আমার কাছে ২শ মতো আছে...
পকেট হাতড়ে হতাশ হলাম, যা বলেছি তার কম পড়ে যাচ্ছে...
পরী বলে, আমি কিন্তু এক টাকাও দিতে পারব না...
বলি, এখন দিতে হবে না, যদি বিপদে পড়ি তখন কিছু দিও...
রূপসা নদীতে তখন জোয়ার, নৌকা ঘাটে ভিড়ল। হুড খোলা রিকশায় চড়ে বসলাম। মনের ভেতর তখন বসন্তের বাতাস...সিনেমার নামও 'আবার বসন্ত'!
বিকেল তিনটা। রিকশা এসে থামল আমাদের অভিজাত 'শঙ্খ' সিনেমার হলের সামনে। জানলাম, শো শুরু হবে সাড়ে তিনটায়। হলের সামনে মাছি ভনভন করেছে—কোনো মানুষ নেই।
বুকের ভেতর উদাস উদাস লাগল। ভগ্নমনে টিকিট কাউন্টারের সামনে এগিয়ে যাই—লম্বা লাইন নেই, নেই ঠেলাঠেলি, নেই চিৎকার...নেই টিকিট ব্ল্যাকারের হাঁক...এই ডিসি...ডিসি...
চোখের পাতায় অতীতস্মৃতির নাচন...
কাউন্টারের ছোট ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে বলি, ভাই, ডিসির দুটো টিকিট দেন...
—বক্স এর টিকিট নেন, নিজেদের মতো নিরিবিলি বসে সিনেমা দেখতে পারবেন।
—স্যরি স্যার, কোনো দরকার নাই...ডিসি দেন...
—২৪০ টাকা দেন...
পেছন ফিরে ওকে বললাম, টাকা দেও, দিল...ও-ই দেবে, ও-ছাড়া আর কে দেবে, ও-ছাড়া আর কেউ নেই যে আমার!
সামনের দোকান থেকে এক বোতল পানি কিনলাম। একামনে বলি, ফ্রিজের কনকনে ঠাণ্ডা পানি...
দোকানের ছেলেটিও একাএকা বলে, গরম হতে সময় লাগবে না...
হারামজাদা বদ। সবাইকে এক চোখে দেখে। তোদের মতো নষ্ট চোখের কারণে, এখন আর কেউ সিনেমা দেখতে আসে না। ওরে বদ, তোর হয়ত জানা নেই, আগে মহিলা দর্শকই বেশি ছিল। তোদের কারণেই মহিলারা এখন ঘরে বসে ইন্ডিয়ার কুসংস্কৃতিমার্কা সিরিয়াল দেখে।
১৪শ সিনেমা হল থেকে এখন ২শ সিনেমা হল টিকে আছে; ঢাকার 'রাজমনি' হলটিও হারিয়ে যাওয়ার তালিকায় যোগ হলো শুনতে পাই!
সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এলাম। একটা ছেলে বলল, ডিসির টিকিটের দাম কিন্তু ৮০ টাকা করে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, বেশি নিল যে!
আবার কাউন্টারে গেলাম। কিন্তু বদমাশটা আমাকে উল্টাসিধা যা বোঝানোর বুঝাতে লাগল।
আমিও বুঝে গেলাম—বাড়তি টাকা ফেরত দিবে না। অগ্যতা মেনে-নিয়ে ফিরে এলাম।
আমরা দর্শক মোটে ৬জন। মানে তিনজোড়া দম্পতি।
গহীন আঁধার কেটে পাশাপাশি দুটো সিটে বসি পড়ি। পর্দায় তখন সিগারেট আর মদ পান না-করার বিজ্ঞাপন।
স্কয়ার এর চাকা সাবান আর ম্যাজিক টুথ পাউডারের বিজ্ঞাপনও দেখানো হলো। এক সময়ের নাম্বার ওয়ান দেশসেরা রোমান্টিক নায়ক রিয়াজ আর পপি আপা— সাবানের বিজ্ঞাপনে!
আহা সেই পপি—সে আগুনসুন্দরী!
আগের আগুনের সে উত্তাপ আর ছড়ায় না। আমিও কিছু টের পেলাম না।
এরপর পর্দায় আমাদের জাতীয় পতাকা ভেসে উঠল, মাত্র একজন বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। স্যালুট ম্যান।
সিনেমা হলের ভেতর অন্ধকার পুরো কাটেনি, পেছনের দম্পতির নারী কণ্ঠ উচ্চসরে প্রশ্ন ছুড়ল—এত ঘোলা কেন?
যৌক্তিক প্রশ্ন। আমি ভাবলাম, হয়ত সিনেমা শুরু হলে পরিষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু ভুল ভাঙল আমার।
অনন্য মামুন পরিচালিত 'আবার বসন্ত' সিনেমার নামটিও পর্দায় আবছা কুয়াশার চাদরে মোড়া, সিনেমার কুশীলবদের নামও ঘোলাটে, অস্পষ্ট; আমি পড়তে পারলাম না। ভাবি, হয়ত একটু পর ঠিক হয়ে যাবে...কিন্তু একটু একটু করে সময় যায় আর আমি আশাহত হই, দিনের কুয়াশা আর কাটে না...পুরো সিনেমায় আর কাটেনি...মনে হচ্ছে আমি ৩৫মি.লি এ ধারণ করা ৬০ দশকের কোনো সিনেমা দেখছি...যা এতদিন আর্কাইভে ছিল!
২০১৯ সালের ৫ই জুন ঈদে মুক্তি পাওয়া একটা ডিজিটাল সিনেমার এ হাল কেন?
নাকি আমাদের 'শঙ্খ' সিনেমা হল বয়সের ভাবে ক্লান্ত, বয়স হয়েছে চোখে ছানি মানে পর্দায় ছানি পড়েছে!
সিনেমা শুরু কিছু সময় যেতেই হুড়মুড় করে তিনজোড়া কলেজপড়ুয়া জুটি আমাদের সামনে জোড়ায় জোড়ায় বসে পড়ল। আমি বুঝে গেলাম—আমার ছবি দেখায় বারোটা বাজল এই উদুমধুমাদের কারণে!
সিনেমা দেখার সময় পিনপতন নিরবতাই আমার প্রত্যাশা, তা হোক ঘরে বা সিনেমা হলে। পুরো মনোযোগ ছাড়া আমি সিনেমা দেখতে পারি না। কেউ কথা বললে রাগ লাগে।
এই যে, আমার পাশে পরীর মতো মেয়েটা—একেও আমি ভুলে যাবো এই আড়াই ঘণ্টা!
আমার ধারণা সত্যি হলো, সামনের সারিতে বসা ছয়জন উদুমধুমাদের কণ্ঠ পর্দার কণ্ঠকে ছাপিয়ে গেল! ওদের উচ্চ হাসি আমার বুকে ঢিপঢাপ বাজল।
অশিক্ষিত, বর্বর...তোরা যে সিনেমা দেখতে আসিসনি—তা বোঝানোর কী খুব দরকার ছিল রে?
দুঃখিত পাঠক...
হ্যাঁ, সিনেমার কাহিনী অতিসরল:
"ইমরান চৌধুরী (তারিক আনাম খান) দেশের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তার সন্তানদের সাথে তার ১৫ বছর ধরে কোন যোগাযোগ নেই। তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর কেউ তাকে দেখতে আসে নি। একাকীত্বে ভোগা ষাটোর্ধ্ব ইমরান চৌধুরী সম্পর্কে জড়ান ২৫ বছরের তিথি মোস্তফার (অর্চিতা স্পর্শিয়া) সাথে। অর্চিতা স্পর্শিয়ার কাছে নিজের হারানো সেই বসন্তের খোঁজ করতে গিয়ে সমাজ-সন্তানের কাছে প্রতিনিয়ত অপমানিত হচ্ছেন, বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ইমরান চৌধুরীর ছেলেমেয়েরা। ব্যাপারটা গড়ায় আদালতে...
কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিচারকের কাছে ষাটোর্ধ্ব
ইমরান চৌধুরীর বিনীত প্রশ্ন, ‘জীবনের উজ্জ্বল বসন্তগুলো আমার সন্তানদের দিয়েছি। এই শেষ বসন্তে এসে কেন আমি নিজের মতো করে বাঁচতে পারবো না?’
এভাবে জীবনের ৬০ বছর পেরিয়ে আবার বসন্তে ফেরার আকুতি ঝরে পড়ে জ্যেষ্ঠ অভিনেতা তারিক আনাম খানের কণ্ঠে।
পোস্টার দেখে অনেকের মনে হতে পারে সিনেমাটি বুঝি অসম প্রেমের গল্প! মোটেও তা নয় কিন্তু—এটি আসলে জীবনবোধের গল্প, মানবিকতার গল্প, পরিবারের গল্প, একাকিত্বের গল্প।
কাহিনি সরল কিন্তু গভীর, হৃদয়ে বেদনা জাগায়, বিবেকের শেষ দরজায় আলত করে কড়া নাড়ে। আপাতদৃষ্টিতে যা আমরা দেখি, কিন্তু তা নিয়ে মোটেও চিন্তা করি না; ঠিক তেমন একটা বিষয় 'আবার বসন্তে' লম্বা চিত্রায়নে দর্শকের সামনে তুলে ধরা হয়েছে।
সিনেমাটি পরিচালক দর্শকের জন্য একটি বার্তা দিয়েছেন। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট ও সিনেমার বাজারের কথা বিবেচনায় নিলে এ সিনেমাটি একটি সাহসী কাজ। পরিচালকের বাহবা প্রাপ্য।
তারিক আনাম খানও বলেছেন, 'পরিচালক অনন্য মামুন এ সময়ে এসে আমাকে উপজীব্য করে একটি সিনেমা করার সাহস করেছেন—এজন্য তাকে সাধুবাদ জানাই।’
সিনেমায় ইমরান চৌধুরীর যে বিশাল অট্টালিকাটি দেখানো হয়েছে তা দৃষ্টিনন্দন, কিন্তু ইনডোর দৃশ্যের সঙ্গে মেলানো কষ্টকর, এত ছোট ড্রয়িংরুম মানা যায় না! কেমন মলিন ও দারিদ্র্যতার ছাপ। সোফা, টি-টেবিলগুলো চোখে সস্তা ও অসুন্দর লেগেছে। মোট কথা গৃহসজ্জা মোটেও যথাযথ মনে হয়নি।
সিনেমায় লং শট নেই বলতে গেলে, সব ক্লোজ শট। ক্যামেরার কাজে মন ভরেনি।
সিনেমায় 'মিলন হবে কতদিনে' এবং 'বেপরোয়া' গান দুটোর চমৎকার প্রয়োগ ছিল।
সমাজ ও মানুষের উপর তিথি (অর্চিতার) খেদ প্রকাশটা উপভোগ করেছি।
আদালতে দাঁড়িয়ে তারিক আনামের অভিনয় ও সংলাপে ডুবে ছিলাম, মন ভরে গেছে।
আমাদের সিনেমায় আমাদের গুণী শিল্পীদের চরিত্রের ভূমিকা কম থাকে, তাদের অভিনয় দেখার সুযোগ পাই না। এটাতে সে আশা পূরণ হয়েছে।
‘আবার বসন্ত’তে বিভিন্ন চরিত্রে আরও আছেন মনিরা মিঠু, ইমতু রাতিশ, মুকিত, আনন্দ খালিদসহ অনেকেই।
তবে মুকিত ও আনন্দ খালিদের অভিনয় প্রাণবন্ত ছিল।
ছবিটি প্রযোজনা করেছে ট্যাম মাল্টিমিডিয়া। ডিজিটাল পার্টনার লাইভ টেকনোলজিস লিমিটেড।
সিনেমা শেষ হতেই আমার পাশের সঙ্গীনির দিকে ফিরে প্রশ্ন করলাম, সিনেমা ভালো লাগল?
সঙ্গিনী স্মিত হেসে মাথা নাড়ল।
পরীর গালের ছোট্ট তিলটার দিকে চেয়ে মনেমনে বললাম—আমাদের জীবন থেকে কখনও বসন্তকে হারাতে দেব না আমি, চির বসন্তে হোক তোমার-আমার বসবাস! তুমি বসন্তের রানি হয়ে আদরে, শাসনে আগলে রেখো বুকের গহীনে!